এক.
প্রেমে প্রতারিত এক তরুণীর আত্মহত্যা দিয়ে ‘পোড়ামন ২’ শুরু। সযত্ম নির্মাণের কারণে প্রথম দৃশ্য থেকে একটা উপভোগ্য সিনেমার আভাস পাওয়া যায়।
গোল বাঁধে দ্বিতীয় দৃশ্যে এসে। ছোটভাই যাইতেছে মক্তবে পড়তে, স্কুল-কলেজের কোনো কথা নাই। স্রেফ মক্তবে পইড়া ভাইরে বড় চাকুরে দেখতে চায় বাপ্পারাজ। এমনটা শুনে হাসি পাইতেছিল। পরের দৃশ্যে বিরক্ত বাড়ল। লুঙ্গি পরা ‘ট্র্যাজেডি কিং’ খাড়ায়া খাড়ায়া প্রস্রাব করছেন। তাও আবার নদী/বিলের দিকে ফিরা। এ জিনিস আপনি কখনো গ্রামে পাইবেন না। সেখানে কিছু সাধারণ নর্ম আছে।
গল্প বললে তো হবে না। এ জিনিসগুলাও মাথায় রাখতে হবে। গল্পকার হয়তো হাস্যরসের জন্য করছেন। বাট ভুলভাল দৃশ্য নির্বাচন।
শুরুর দৃশ্যের আত্মহত্যা নিয়াই গোল বাধে। যা সিনেমার শেষ পর্যন্ত বারবার উচ্চারিত হইতে থাকে। মনে হতে পারে, নায়ক-নায়িকা বড় হওয়া তক ওই গ্রামে ১০ বছরেও কেউ প্রেম করে নাই। প্রেম মানে হলো ‘জেসমিনের মতো আত্মহত্যা’। মা বারবার নায়িকারে এটা মনে করায়া দেয়। অথচ এমন প্রেমহীন গ্রামের এক পা কবরে যাওয়া বুড়িও ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমার জন্য পাগল!
মূলত দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমার অনুকরণে আসা ‘সমাপ্তি দৃশ্য’ আর মৌলিক গল্পের কচকচানি টিকিয়ে রাখার জন্য এই ঘটনা। সেটা আমলে নিয়ে আগে-ভাগে ধরা যায় নায়ক-নায়িকা মারা যাবে।
হ্যাঁ, সিনেমাটা আমার ভালো লাগছে। অভিনয়, নির্মাণ, মনোযোগ মিলিয়ে। যেটা ভালো লাগে নাই সেটাই বলছি।
জেসমিনের লাশ মসজিদের সামনে তার বাপ নিয়া আসে কবর দেওয়ার লাগি। ইমাম সাহেব বলছেন, কিতাবে আছে আত্মহত্যাকারী দোজখে যাবে। তো, জেসমিনের লাগি পুরা গোরস্তানরে দোজখ বানাইতে পারবেন না। ‘গোরস্তান দোজখে পরিণত হওয়া’ এ যুক্তি যদি সত্য হয় তাইলে তো জেসমিনের মৃত্যুর আগেই সেটা হওয়ার কথা। মানে, ওই গ্রামে যারা আগে মরছেন তারা সবাই নিশ্চয় বেহেশতে যান না। যদি না হয়, ধরে নিতে হবে— ওই গোরস্তান মূলত বেহেশতের টুকরা। চিন্তা করেন ব্যাপারটা!
শিল্পে যখন সমাজের প্রচলিত কোনো (কু)সংস্কার হাজির হয় সামনে তার একটা নিদান হয়তো থাকে। কিন্তু এ সিনেমা আড়াই ঘণ্টা একটা বিষয়ের পেছনে দৌড়াতে থাকে— আত্মহত্যা করলে জানাজা হবে না। গল্পকারও পণ করছেন ‘জানাজা হবে না’ এর বিপরীতে যুক্তি দেয়া যাবে না। তাহলে গল্পকারের চেয়ে বড় মোল্লা এই সিনেমায় কে তবে? চিন্তা করেন, নায়ক তখনই নায়ক হয়ে ওঠে যখন সে ওইসব অনাচারের বিরুদ্ধে খাড়ায়। সফল হইতে হবে এমন দিব্যি কেউ তারে দেবে না। নইলে এই অকর্মা, চিন্তাহীন নায়ক দিয়া আমরা কি করব! নাকি এরাই অকর্মা জেনারেশনের প্রতিনিধি।
এ সিনেমার কাহিনিও পরিচালক রায়হান রাফির। লোকমুখে শোনা যায়, তিনি মাদ্রাসা শিক্ষিত ও হাফেজ। ধরে নিলাম জানাশোনা লোক তিনি। কিন্তু ‘আত্মহত্যাকারীর জানাজা’ নিয়া ধর্মের কোনো সুস্পষ্ট বিধান তিনি সিনেমায় দেখাইলেন না। ইচ্ছাকৃতই কি?
নাকি পুরানা সেই যুদ্ধের সৈন্য বনে গেছেন। বাংলার অনেক পণ্ডিত মানুষদের দেখবেন, যাদের প্রতিপক্ষ মূলত কাঠমোল্লারা (প্রচলিত ভাষারীতি)। এদের কথাবার্তারেই তারা ধর্ম জ্ঞান করে। আর তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চান। বাদ পড়ে এর সঙ্গে যুক্ত স্থানীয় ক্ষমতার ভাগাভাগি ও ইত্যাকার বিষয়াদি। তো, এ সিনেমায় অনেক ঘটনা ঘটে। বাট, ‘আত্মহত্যাকারীকে জানাজা’ দেওয়া যাবে না।
এই প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের ‘তেতুল বনের জোছনা’ উপন্যাসের কাহিনি মনে পড়ে গেল। সেখানে আমরা দেখি, শিল্প কীভাবে প্রচলিত বয়ানের বাইরে গিয়া উঁকি দেয়। ক্ষমতাবান কারো দ্বারা অপমানের শিকার হয়া মসজিদের ইমাম আত্মহত্যা করেন। শরীয়তে জানাজার বিধান নাই বইলা তারে কোনো রকমে মাটিচাপা দেওয়া হয়। পরে দেখা যায় অন্য এক ইমাম আইসা পুরো বিষয়টা নতুন করে ব্যাখ্যা করেন, এবং ওই ইমাম সাবের জানাজা হয়।
কাহিনির বাকি দিক বলতে গেলে, ‘পোড়ামন ২’ আমাদের অতিচেনা। তবে এর ভেতরে ঠেসে দেওয়া হয়েছে মজার মজার অনেক দৃশ্য। নির্মাণও মোটামুটি। আবেগের ছড়াছড়িও খারাপ লাগে না। সুন্দর কিছু গানও আছে।
দুই.
শুরুতে আত্মহত্যা আর জানাজা বিষয়ক ঝামেলা শেষ হওয়ার পর আমার বন্ধু তথা ইবনে খালদুন গবেষক বললেন, ‘আর্ট ফিল্ম অংশ শেষ হইছে। এবার শুরু তামিল সিনেমা।’ দাবি করল অনেকদিন বাংলা সিনেমা দেখে নাই। এতদিনে অনেককিছু বদলে গেছে। ‘পোড়ামন ২’ দেখে মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সিনেমায় নায়িকাকে প্রেমিকের সঙ্গে পালাতে সাহায্য করে মা ও দাদী। আর ওই দৃশ্যের আগে নায়িকার ভিলেন বড়ভাইকে যেভাবে থাপ্পড় দিয়া ঘরে পাঠায়া দেয় মা, সেটা আসলে মুগ্ধ হওয়ার মতো। অনেক ক্লিশে ব্যাপার থাকলেও কিছু কিছু জায়গা ডিটেইলসের কারিশমা ছিল। বন্ধু বলল, ‘কী চমৎকার সিনেমা! ইলজিক্যাল কিচ্ছু নাই।’
পালাতে গিয়েও পারল না, নায়ক-নায়িকা ধরা খাইয়া গেল। ও নড়েচড়ে বলল, ‘কী পলিটিক্যাল সিনেমা!’ তারপর বলল, ‘আওয়ামী লীগ আরো ২২ বছর ক্ষমতা থাকবে।’ বিরক্তি হয়ে বললাম, ‘চুপ থাক!’
ইবনে খালদুনের এই গবেষকরে সিনেমা হল থেকে বাইর হয়া জিগাসা করি, ‘কেমনে বুঝলি আওয়ামী লীগ ২২ বছর ক্ষমতায় থাকবে?’ ওর কথায় বুঝলাম, ক্ষমতার মধ্যে ঐতিহাসিকতা থাকতে হয়। এই সিনেমায় নায়ক সুজন শূন্য থেকে আইসা নায়িকার বাপ-ভাইয়ের সকল ক্ষমতারে প্রায় ‘নাই’ করে দিছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত টিকতে পারে নাই। কারণ তার ক্ষমতা ‘নাই’ থেকে আসছে, অন্যদিকে হিস্ট্রিক্যাল লেগ্যাসি থাকার কারণে নায়কের ক্ষমতারে তারা ভ্যানিশ করে দেয়।
আমিও এমন ব্যাখ্যায় তব্দা খায়া গেলাম। তখন বলল, ‘আরে না, আওয়ামী লীগ ২২ বছর ক্ষমতায় থাকবে— এটা কথার কথা।’ কিন্তু আমি ভাবছি হাবিজাবি। এই যেমন; রাজ পরিবারের উত্থান-পতন আর ক্ষমতার বৃত্ত কত বছরে পূর্ণ হয়— এই জাতীয় ক্লাশ নোট। আর ভাবতেছিলাম নিজের জীবদ্দশায় মোটামুটি বেশির ভাগ রাজ-বাদশার খেদমত করছেন খালদুন। আর দুর্দশার দিনও কম আছিল না।
কিন্তু ধরেন ‘তালুকদার পরিবার’ নায়িকার পরিবারের সঙ্গে ওই সমাজ বা অঞ্চলের ক্ষমতা কাঠামো কিভাবে জারিত হয়— তা কিন্তু স্পষ্ট নাই। এমন পাল্টা যে ক্ষমতা হাজির থাকে, তারও কোনো উল্লেখ নাই। নায়কের ক্ষমতা কিন্তু স্রেফ ‘নাই’ থেকে, ব্যাপারটা এমন না। বরং সমাজের মধ্যে নানান ধরনের ক্ষমতার বুদবুদ থাকে তার একটা। তারপরও তার একলা হয়ে যাওয়া বিভ্রান্তিকর। বাট, একটা লিনিয়ার গল্প ও একটা নির্দিষ্ট অভিমুখে যাইতে হলে গাছের অন্য ডালপালা আছে সেটা স্বীকার করা যাবে না। না করলেও সেটা তো থাকেই। আমরা এটা চিন্তা করলেই বুঝতে পারি।
তিন.
এই পয়েন্টে আসলে বলার তেমন কিছু নাই। সিনেমাটির বেশ কিছু রিভিউ পড়ছি। যাতে বেশিরভাগ মন্তব্যেই ইতিবাচক। দুই-একটা জায়গায় কারো কারো খুঁতখুঁত চোখে পড়ছে। পরিচালকের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হইছে— এসব ব্যাপারকে তিনি ‘ষড়যন্ত্র’ হিসেবে দেখছেন। অথচ দেখেন বাংলাদেশে আপনি সবকিছুর মধ্যে ‘ষড়যন্ত্রের গন্ধ’ পাইলেও খোদ এ সিনেমায় কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ নাই।
বলি কী— এই লেখা ও অন্য আরো অনেক লেখায় কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ নাই। সবাই মনের কথাই বলছে খুশি হয়া। আর ‘ষড়যন্ত্র’ করেও লাভ নাই। সিনেমা হলে দেখে আসছি, সিনেমাটা দর্শকরা বেশ পছন্দ করছেন। আর মোটের উপ্রে আশা করা যায়, জাজ মাল্টিমিডিয়া ভারত নির্ভরতা বাদ দিয়া দেশি প্রতিভাদের বেশি বেশি সুযোগ দেবে।