বাংলা চলচ্চিত্রের নন্দিত অভিনেত্রী ফরিদা আক্তার পপি। যিনি ববিতা নামেই সর্বাধিক পরিচিত। সত্তর ও আশির দশকে অদম্য নায়িকা হয়ে বাংলা চলচ্চিত্রের সাদাকালো পর্দায় আলো ছড়ানো এ অভিনেত্রী এখনো দর্শক-হৃদয়ে অমলিন।
চলচ্চিত্রে আসার পেছনে ববিতার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা ছিলেন তার বড় বোন চিত্রনায়িকা সুচন্দা। কিংবদন্তি নির্মাতা জহির রায়হানের ‘সংসার’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে ১৯৬৮ সালে অভিষেক হয় ববিতার। এই চলচ্চিত্রে তিনি রাজ্জাক-সুচন্দার মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। তার নাম ফরিদা আক্তার পপি থেকে ‘ববিতা’ হয় জহির রায়হানের ‘জ্বলতে সুরুজ কি নিচে’ সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে।
নায়িকা হিসেবে ববিতার প্রথম সিনেমা ‘শেষ পর্যন্ত’ মুক্তি পায় ১৯৬৯ সালের ১৪ আগস্ট। এর পর থেকে নায়িকা হিসেবে অর্জন করেন তুমুল জনপ্রিয়তা। জহির রায়হান পরিচালিত ‘টাকা আনা পাই’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে ববিতা দর্শকপ্রিয়তা পেলেও তার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র বলা হয় ‘অশনিসংকেত’কে। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় এই সিনেমায় অভিনয় করে ববিতা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দারুণ প্রশংসা অর্জন করেন।
গুণী এই অভিনেত্রী জন্মদিন ছিল মঙ্গলবার(৩০ জুলাই)। কথা ছিল, এবারও জন্মদিন কাটবে কানাডায় একমাত্র ছেলের কাছে। কয়েক বছর ধরে দিনটিতে এমনটাই হচ্ছে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক দিন হাসপাতালে থাকার কারণে এবার আর তা হয়নি।
দ্বিতীয়বারের মতো করোনায় আক্রান্ত হয়ে গত ১৮ জুলাই একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। চার দিন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলেও বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসক।
জন্মদিন উপলক্ষে দেশের শীর্ষ স্থানীয় একটি জাতীয় দৈনিক তার সাক্ষাৎকার নেয়। সেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন ববিতা।
জীবনের এই সময়ে এসে জীবনটা নিয়ে কী উপলব্ধি হয়? এমন প্রশ্নের জবাবে ববিতা বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তিত। গেল বেশ কিছুদিন দেশ ইন্টারনেট থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। আত্মীয়স্বজন সবই তো দেশের বাইরে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়, খোঁজখবর নিতে হয়। কিন্তু পারিনি। এখনো সেভাবে পারছি না। তাই মনটা খারাপ আরকি। এই সময়ে এসে ইন্টারনেট বন্ধ করাটা তো মোটেও যৌক্তিক নয়।
এই সময় জন্মদিনে কেমন উদ্যাপন হয়? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আয়োজন করে জন্মদিন কখনোই উদ্যাপন করিনি। আমি মনে করি, এ নিয়ে এত হইচই করার কিছু নেই। মনে হয়, জীবন একটাই, এখনো অনেক কিছু করার আছে। কী করতে পারলাম না, এসব নিয়ে ভাবি।
ববিতা আরও বলেন, কয়েক বছর ধরে জন্মদিনে ঢাকায় থাকলে সুবিধাবঞ্চিত অনেক শিশু আমার বাসায় আসে। গান শোনায়, আড্ডা দেয়, ওদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খাই। ছোট বোন চম্পা ও বড় বোন আসেন, এ-ই যা!
এই যে উদ্যাপন কমে যাওয়া, এতে কি চিন্তা বা ভয় হয়? প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে গুণী এই অভিনেত্রী বলেন, ভয় লাগার কিছু নেই। নিয়মিত ইবাদত করি, প্রতিদিন একবার মৃত্যুর কথা ভাবি। আমার খুব ইচ্ছা, আমাকে যেন বাবার কবরে সমাহিত করা হয়। আমার আব্বা বনানী কবরস্থানে ঘুমিয়ে আছেন।
শিল্পীজীবনের অর্জন কী, জানতে চাইলে একসময়ে সাড়া জাগানো এই নায়িকা বলেন, শিল্পীজীবনে যা কিছু পেয়েছি সবই অর্জন। তবে, মানুষের ভালোবাসা শিল্পীজীবনের বড় অর্জন। এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কিছুই হতে পারে না।
ববিতার সিনেমায় যাত্রা শুরু ৫০ বছর আগে। রোমান্টিক-সামাজিক থেকে শুরু করে সব ধরনের সিনেমায় তিনি অভিনয় করেছেন।
১৯৭৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তনের পর টানা তিনবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জেতেন তিনি। এ ছাড়া ১৯৮৫ সালে আরেকবার শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী, ১৯৯৬ সালে শ্রেষ্ঠ প্রযোজক, ২০০২ ও ২০১১ সালে পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এ ছাড়া ২০১৬ সালে তাকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।
তিনি প্রায় ২৫০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— ‘সুন্দরী’, ‘এক মুঠো ভাত’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘বসুন্ধরা’, ‘সোহাগ’, ‘ফকির মজনুশাহ’, ‘ওয়াদা’, ‘লাঠিয়াল’, ‘কথা দিলাম’, ‘নিশান’, ‘এতিম’, ‘লাইলী মজনু’, ‘দূরদেশ’, ‘মিস লংকা’, ‘ফুলশয্যা’, ‘বীরাঙ্গনা সখিনা’, ‘মিন্টু আমার নাম’, ‘বেহুলা লখিন্দর’, ‘ফুলশয্যা’ ইত্যাদি।