মন কেড়ে নিলো ‘পোড়ামন’

একটা ছবি মানুষ কেন দেখে ? ভাল লাগে তাই! যদি বলি খুব বেশি ভাল লেগে যায় তাহলে কি করে ? বার বার দেখে ।

মানুষ নাকি মুগ্ধ হতে পছন্দ করে । কিন্তু সে মুগ্ধতা যদি কষ্টের হয় ? বেদনার হয় ? তাহলে? বলছি মুগ্ধতার ছবি, স্তব্দতার শেষ বিন্দুতে পৌঁছে যাওয়ার ছবি ‘পোড়ামন’ এর কথা ।

নায়িকা বড় লোকের মেয়ে, নায়ক গরীবের সন্তান । দু’জনের মাঝে হলো প্রেম । প্রেমের বাধা খলনায়ক । অনেক ঘটনার ঘনঘটার পর হলো তাদের মধুর মিলন । অত:পর তাহারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো ।

কী ভাবছেন ? এটাই ‘পোড়ামন’-এর গল্প?  না যা ভাবছেন তা নয় । এই ছবির গল্পটি আর দশটা গড়পরতা বাংলা ছবির মত নয় মোটেও । পোড়ামনে ছোট্ট সুজনের লেখাপড়া ভালো লাগে না তাই তার বাবা তাকে টেম্পুর হেল্পারিতে কাজে লাগিয়ে দেয় । একদিন সে টেম্পু নিয়ে যাবার সময় দেখতে পায় তিনমাস বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার কারনে পরী ও তার মাকে বাড়িওয়ালা বের করে দিচ্ছে । সুজন তাদেরকে তার এক দাদীর বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেয় । পরীর পুরো পরিবারের দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নেয় । পরীর পড়ার সমস্থ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে খরচ পর্যন্ত সে বহন করে । ধীরে ধীরে পরী ও সুজনের মাঝে ভালবাসা গড়ে উঠে । পরীর মা সুজনকে জামাই বলে ডাকতে থাকে । কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন তিনি পরীকে সুজন বাদে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে দিতে যান । অন্য দিকে কর্তব্যপরায়ণ সৎ পুলিশ অফিসার আবিদ ।  তার স্ত্রী তিন সন্ত্রাসী ভাইয়ের একমাত্র বোন ও একজন সন্দেহপ্রবণ মহিলা ।

আপাতত দৃষ্টিতে সাদামাটা মনে হলেও পর্দায় অসাধারণ  এক  প্রেমগাঁথা হয়ে উঠেছে ‘পোড়ামন’ … পরিচালক জাকির হোসেন রাজু তার অন্যবদ্য চিত্রনাট্য ও পরিচালনায় ছবির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দর্শকদের টেনে নিয়ে গেছেন । পরের দৃশ্যে কী চমক রয়েছে তা  আগের দৃশ্য দেখে বুঝে উঠা যাচ্ছিলোনা । ছবিটির শেষ দৃশ্য মানুষ পিনপতন নীরবতায় ও মুগ্ধতায় দেখেছে । মনে হচ্ছিলো শেষ হইয়াও হইলো না শেষ! ছবির প্রতিটি দৃশ্যই দর্শকদের জন্য এমনই জাদু সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলো ।

ছবির সংলাপও ছিলো সুন্দর ও সাবলীল । ছোট-খাটো কিছূ বিষয় দৃষ্টিগোচর করলে সার্বিক বিবেচনায় ছবির কাহিনীকার ও সংলাপ রচিয়তা হিসেবে ফারজানা ধন্যবাদ পাবার যোগ্য ।

ছবিতে সবার অভিনয় দারুন ছিলো । বিশেষ করে সাইমন ‘সুজন’ আর আনিসুর রহমান  মিলন পুলিশ অফিসার ‘আবিদ’ এর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছেন । শেষ দৃশ্যে সাইমনের ‘আমি আইতাছি পরী, আমি আইতাছি’ সংলাপের সাথে তার অভিব্যক্তি, কান্না এক কথায় অসাধারণ ছিল যা দর্শকের হৃদয় ছুঁয়ে যায় । একই দৃশ্যে মিলনের স্তব্ধতা অপূর্ব ছিল । সে তুলনায় মিলনের স্ত্রী চরিত্রে বিপাশা ভালো কাজ দেখাতে পারেননি। তাকে ‘আইটেম গার্ল’ থেকে নায়িকা কিংবা অভিনেত্রী হতে হলে আরও পরিশ্রম করতে হবে । বিশেষ করে তার কথা বলার ভঙ্গি ও উচ্চারণ নিয়ে আরো কাজ করতে হবে। ছবিতে সুজনের বন্ধু , পুলিশের হাবিলদার চরিত্রে রতনের কৌতুকাভিনয় দর্শক উপভোগ করেছে । ছোট পর্দার অভিনেত্রী মনিরা মিঠু এই ছবিতে পরীর মা রূপে ভাল করেছেন । এইছাড়া অন্যান্য চরিত্রে মিশা সওদাগর, ডন, শিবা শানূদের পর্দার উপস্থিতি খুব কম সময়ের হলেও তারা ভাল অভিনয় করেছেন । একসাথে মাহী ও সাইমনের ছোটবেলার দৃশ্যে অভিনয় করা শিশুশিল্পী দু’জনও ভাল করেছেন ।

বাংলা ছবির প্রাণ বলা হয় গানকে । আর এই ছবির গানগুলো করেছেন প্রখ্যাত সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ও শফিক তুহিন । জাকির হোসেন রাজু নিজে একটা গানের কথা লিখেছেন । ছবিটির ‘পরী’, পোড়ামন’ ও ‘বিধাতা’ গানের কথা ও সুর অসাধারণ । তবে গানগুলোর কোরিওগ্রাফি আরও ভালো হতে পারতো। ক্যামেরার কাজ ঠিক-ঠাক। পাহাড়ের রাস্তা দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাবার দৃশ্য কিংবা বাস চলাচলের দৃশ্যে ও রাতের দৃশ্য গুলা বেশ ভালো ছিলো।গাড়ি দুর্ঘটনার দৃশ্যটি আরও ভালভাবে ফুটিয়ে তোলা যেতো । জোনাকির অ্যানিমেশনটি ভাল হলেও জোনাকির রঙ সবুজ কিনা তা নিয়ে তর্ক হতে পারে। তারপরও এক্ষত্রে তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানানো যায় ।

এই ছবির ত্রুটিগুলো আসলে খুবই সামান্য । দর্শকদের ভুলিয়ে রাখবে ছবিটির অসাধারণ গল্প আর নির্মাণশৈলী । পোড়ামন  শুধু মুগ্ধ বা স্তব্ধ করবে না,  বুকে হাহাকার সৃষ্টি করবে, অদ্ভূত এক কষ্ট দানা বাঁধবে। সেই কষ্টটাও এক অপূর্ব অনুভূতি অসাধারণ এক ছবির জন্য ।

শ্রদ্ধেয় হুমায়ূন আহমেদ বলেছিলেন মানুষ নাকি মুগ্ধ হতে পছন্দ করে । হ্যাঁ আপনি যদি মুগ্ধ হতে চান, স্তব্ধ হতে চান , বাকহারা হতে চান তবে ‘পোড়ামন’ ছবিটি দেখুন বাংলাদেশের বর্তমান সময়ের ছবি নিয়ে যাদের নাক সিটকানি ভাব আছে তাদেরকে ছবিটি দেখার জন্য অনুরোধ করবো।  মনে হয় আপনার নাক সিটকানির দিন ফুরিয়ে এলো।

 

একনজরে ‘পোড়ামন’

পরিচালনা, চিত্রনাট্যঃ জাকির হোসেন রাজু
কাহিনী ও সংলাপঃ ফারজানা
অভিনয়েঃ সাইমন, মাহী, আনিসুর রহমান মিলন, মনিরা মিঠু, বিপাশা, মিশা সওদাগর,ডন, শিবা শানূ
চিত্রগ্রাহকঃ শফিউল্লাহ শাহীন
সম্পাদনাঃ তৌহিদ হোসেন চৌধুরী
গ্রাফিক্সঃ সৈকত নাসির
পোস্টার ডিজাইনঃ জাফরিন সাদিয়া
শব্দ গ্রহনঃ কাজী সেলিম
মেক আপঃ মোঃ জাবেদ
স্থিরচিত্রঃ আলতাফ হোসেন চৌধুরী
গীতিকারঃ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শফিক তুহিন
সঙ্গীত পরিচালনাঃ আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল, শফিক তুহিন, জাকির হোসেন রাজু
সঙ্গীত শিল্পীঃ শফিক তুহিন, কণা, মীম, কিশোর, পুলক, খেয়া
শিল্প নির্দেশনাঃ কালন্তর
পোশাকঃ সিনথিয়া
ম্যানেজমেন্টঃ মোঃ উজ্জ্বল
প্রযোজনাঃ জাজ মাল্টিমিডিয়া

পোড়ামন ছবির ত্রুটিগুলো খুবই সামান্য । দর্শকদের ভুলিয়ে রাখবে ছবিটির অসাধারণ গল্প আর নির্মাণশৈলী । পোড়ামন শুধু মুগ্ধ বা স্তব্ধ করবে না, বুকে হাহাকার সৃষ্টি করবে, অদ্ভূত এক কষ্ট দানা বাঁধবে। সেই কষ্টটাও এক অপূর্ব অনুভূতি অসাধারণ এক ছবির জন্য ।

Leave a Reply

Your email address will not be published.