সিনেমায় মাত্র তিনটি জিনিস চলে; বিনোদন! বিনোদন! বিনোদন!
ইদানিংকালের হিন্দী ছবির একটি বিখ্যাত সংলাপ। যারা ‘এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী’ তাদের জন্য ‘রোমিও বনাম জুলিয়েট’ একটি ‘পরিপূর্ণ প্যাকেজ’ হতে পারে।
বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত ছবিটির মূল চরিত্রে আছেন কলকাতার অঙ্কুশ এবং আমাদের দেশের মাহি। কিন্তু মাহিকে ছবির বিরতি আগ পর্যন্ত একপ্রকার সংলাপ বিহীন দেখা গেছে।
সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ‘দেশা-দ্য লিডার’ এ মাহিকে যতটা গ্ল্যামারাস হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে এ ছবিতে ততটা খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে মাহির অভিনয়ের চিরায়িত ‘ন্যাকামি’ অনুপস্থিত ছিল। যা কিনা তার সুঅভিনেত্রী হবার অনবরত প্রচেষ্টার ইঙ্গিত দেয়।
এলাকার বাউন্ডেলে ছেলে হিসেবে ‘রোমিও’ পরিচিত। মোড়লের ভাগ্নিকে প্রেমের ফাঁদে ফেলতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যায়। বাঁচার জন্য ফেসবুক থেকে ‘জুলিয়েট’র ছবি নামিয়ে বলে তার প্রেমিকা। কিন্তু তাকে একমাসের মাঝে ‘জুলিয়েট’কে বউ হিসেবে গ্রামে আনতে হবে। কী করা! ট্র্যাকর কেনার জমানো টাকা দিয়ে ভিসা যোগাড় করে লন্ডনে উড়াল। সেখানে জুলিয়েটের ‘বিশ্বস্থ’ মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা এবং তাকে নিজের গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসা।
ছবির মূল কাহিনী এতটুকুই। কিন্তু দর্শককে শেষ পর্যন্ত টেনে নেবার জন্য চিত্রনাট্যের ‘ট্রানজিশন পয়েন্ট’ গুলো দারুন। ছোট ছোট ‘পাঞ্চ লাইন’র মাধ্যমে দর্শককে হাসানোর প্রচেষ্টা ছিল। যা দর্শক ভালভাবে নিয়েছেও।
কলকাতার বাণিজ্যিক ছবির নায়কদের মাঝে অঙ্কুশের অভিনয় নিয়ে সমালোচনা আছে। এ ছবিতে কিছু কিছু জায়গা ব্যতীত মোটামুটি উতরে গেছেন।
‘বাণিজ্যিক ছবি’ এ অজুহাতে হয়ত রোমিও’র রাতারাতি লন্ডনের ভিসা পেয়ে যাওয়া ভুল হিসেবে ধরা যাবে না। কিন্তু একজন মা তার সন্তানের জন্য বিয়ের সব আয়োজন করে রেখেছেন, ছেলের ‘প্রেমিকাকে’ নিজের ‘বউমা’ হিসেবে জানছেন। কিন্তু ‘মিথ্যাবাদী’ ছেলে ক্ষমা চাইবার সাথে সাথে ক্ষমা করে দেওয়া কিংবা লন্ডনে বড় হওয়া সবসময় ইংরেজি বলা জুলিয়েটের কোন প্রকার কারও সাহায্য ছাড়ায় ভাল বাংলা বলতে পারা কিছুটা ‘খটকা’ লাগে। কিন্তু বিনোদন যেখানে আসল বিষয়বস্তু সেখানে এসব আমলে না নেয়াই যেতে পারে।
তবে ছবির দৃশ্যে বোঝানো হচ্ছে জুলিয়েটের আত্মীয় রোমিওকে ইংরেজিতে কিছু বলছেন সে ঠিকমত না বুঝে উত্তর দিচ্ছে অথচ পর্দায় ঐ বিদেশীর সংলাপ বাংলায়। এটা বোধকরি বাণিজ্যিক ছবির অজুহাতে বাদ দেওয়া যায় না।
যৌথ প্রযোজনা হবার কারণে কিংবা দুই দেশে চলার কারণে খুব সচেতনভাবে নায়ক নায়িকার ‘ধর্ম’ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। সৃষ্টিকর্তার কোন নাম উল্লেখ না করে শুধু বারবার ‘উপরওয়ালা’ বলা কিংবা রোমিওর মাকে প্রার্থনা করতে দেখানো হলেও সামনে কোন মূর্তি কিংবা অন্য কিছু না দেখানো উল্লেখ করা যায়।
মাহি ছাড়া এ ছবিতে বাংলাদেশের আলীরাজ, রেবেকা, তানভীর তনু, সুব্রতসহ কিছু শিশুশিল্পী অভিনয় করেছেন। এদের মাঝে কাবিলা ব্যতীত অন্যদের উপস্থিতি অনেকটা ‘অতিথি শিল্পী’র মত। কাবিলাকে মনে হয়েছে তার নিজের স্বাভাবিক ঢঙ্গের বাইরে অভিনয় করার চেষ্টা করেছেন। সব মিলিয়ে তাদের কারও অভিনয় খারাপ হয় নি।
তবে রোমিওকে সাহায্যকারী বন্ধু ‘তনু’র অভিনয় অতটা ভাল না লাগলেও জুলিয়েটের প্রেমিক ‘রাহুল’ চরিত্রে অভিনয়কারীর অভিনয় ভাল লাগে। তার অঙ্গভঙ্গীর সাথে ক্যামেরার মুভমেন্ট সত্যিই প্রশংসনীয়।
যেহেতু ছবির সবকয়টি গানের কথা, সুর, কোরিওগ্রাফি কলকাতার শিল্পীদের করা তাদের আর দশটা ছবির মত এটিও উপভোগ্য ছিল। তবে ছবির লন্ডন অংশের অ্যাকশন দৃশ্যগুলো ভাল লাগলেও রোমিওর গ্রামের অংশটুকু তেমনভাবে মনে ধরেনা।
ছবির একটি দৃশ্যে বাংলাদেশের ভারতের কাছে ৫৮রানে ৯ উইকেট হারিয়ে ফেলার ক্রিকেট ম্যাচটি দেখানো হয়। যারা একে ‘যৌথ প্রতারণা’ বলছেন তারা কিংবা যদি সাধারণ একজন দর্শক প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ ভারতের কাছে হারছে এমন অনেক ম্যাচ আছে, তাই বলে নির্লজ্জ্বভাবে হারার ম্যাচ কেন ছবিতে ব্যবহার করা হল? বিষয়টা কতকটা দেশপ্রেমের চেতনায় বাধা দেয়।
ছবিটি পাঞ্জাবি ‘সিং ভার্সাস কউর’ ছবির ‘ফ্রেম টু ফ্রেম’ কপি। কিন্তু এটি ‘রিমেক স্বত্ত্ব’ ছাড়া বানানোর অভিযোগ আছে। এখন যৌথ প্রযোজনার উদ্দেশ্য হয় যদি দুদেশের সিনেমার উন্নতি। সেক্ষেত্রে রিমেক বা নকল সিনেমা দিয়ে কতটুকু সম্ভব, প্রশ্ন করা যায়ই। নায়িকা ব্যতীত বাকি বাংলাদেশী শিল্পীরা নামমাত্র থাকলে তাতে আমরা কতটুকু লাভবান হব, ভাবনার বিষয়।
লাল, সাদা বিভিন্ন রঙে একধরনের মিঠাই পাওয়া যায় তার নাম ‘হাওয়াই মিঠাই’। যা কিনা মুখে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ স্বাদ লাগে। এরপর এর কোন স্বাদ জিহ্বায় লেগে থাকে না। ছবিটিও যতক্ষণ দেখবেন ততক্ষণ আপনাকে বিনোদন দিবে। কিন্ত হল থেকে বেরিয়ে আপনি যদি কিছু মনে রাখতে না পারেন কী দেখেছিলেন, আশ্চর্যের কিছু হবে না।
হাওয়াই মিঠাইয়ের পর আমাদের দেশের দর্শকরা এরপর হয়ত ‘রসগোল্লা’ আশা করতেই পারেন। তবে পরের ছবিগুলোতে এমন হাওয়াই মিঠাই কিংবা রসগোল্লার এই মিঠারস থাকবে কী? প্রশ্নটা থেকেই যায়!