কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমাবেশ করেছে থিয়েটারকর্মী, আলোকচিত্রী সমাজ, দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ, গেট আপস্ট্যান্ড আপ (বাংলাদেশ সংগীতশিল্পী সমাজ)।
শনিবার (১০ আগস্ট) বিকেলে এ সমাবেশ করেন তারা। সমাবেশের শুরুতে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আন্দোলনে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সমাবেশে বলা হয়, ‘আমরা মনে করি, সময়টা শুধু উদ্যাপনের নয়; সময়টা রাষ্ট্র পুনর্গঠনের। আমরা বিশ্বাস করি, এই নতুন বাংলাদেশ সব জাতির, সব বর্ণের, সব ধর্মের, সব লিঙ্গের একটি বৈষম্যহীন জনপদ হয়ে উঠবে।’
সমাবেশে চার মাধ্যমের পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি পাঠ করা হয়। বিবৃতি পাঠ করেন নির্মাতা, অভিনেত্রী ঋতু সাত্তার।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই বিশেষ সময়ে আমরা স্মরণ করছি, এই গণ–অভ্যুত্থানের সব শহীদকে যাঁদের নির্বিচার গুলি করে হত্যা করেছে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড। শুধু তা–ই নয়, জুলাই-আগস্টজুড়ে তাদের পেটোয়া বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্বিচার গণগ্রেপ্তার, গুম ও নৃশংস অত্যাচারে গুরুতর আহত হয়েছেন হাজারো ছাত্র–জনতা। নির্মম দুর্ভাগ্য এই যে জাতি হিসেবে তাদের মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান ও নাম এখন পর্যন্ত আমরা জানতে পারিনি।’
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। এই সরকারের কাছে থিয়েটারকর্মী, শিল্পী ও আলোকচিত্রীদের দাবি, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় খুন ও সন্ত্রাসের কারণে যাঁরা শহীদ ও গুরুতর আহত হয়েছেন, তাঁদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিতে হবে ও আহত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন করতে হবে। শহীদদের স্মরণে স্থাপন করতে হবে শহীদ মিনার। সর্বোপরি এই নৃশংস রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করে সব অপরাধীকে আইনের আওতায় আনতে হবে।’
যৌথ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘গণ–অভ্যুথান-পরবর্তী সময়েও অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে দেশব্যাপী নানা ধর্মীয় সম্প্রদায়, ভিন্নমত ও নানা শ্রেণি–পেশার মানুষ হত্যা-নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। হামলা ও লুটপাট হয়েছে ধর্মীয় উপাসনালয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসভিত্তিক স্থাপনা, ঐতিহ্যবাহী ভাস্কর্য, সংগ্রহশালা, জাদুঘর, স্মৃতিস্মারকসহ শিল্পী, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতিকর্মীদের বাড়ি। আমরা মনে করি, অগ্নিসংযোগ, হামলা, ধ্বংস ও লুটপাটের সঙ্গে জড়িত একটি বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহল, যারা আমাদের এই বিজয়ের সব অর্জন ম্লান করে দিতে চায়।’
‘বিপ্লবী ছাত্র–জনতা আমাদের উপহার দিয়েছে এক নতুন মুক্তি। তারাই জান বাজি রেখে রক্ষা করে যাচ্ছে দেশের সম্পদ। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সংকটময় সময়ে তারাই দায়িত্ব নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার। পাহারা দিয়ে যাচ্ছে মন্দির, মাজারসহ বিভিন্ন উপাসনালয় ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার। দুষ্কৃতকারীদের ঠেকাতে সংঘবদ্ধভাবে টহল দিয়ে যাচ্ছে পাড়া–মহল্লায়। আন্তরিকতার সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে যাচ্ছে দিন–রাত। সরকার পরিবর্তনের এই বিশেষ সময়ে প্রশাসনিক অনুপস্থিতিতে ছাত্র–জনতাই ধরে রাখছে দেশের হাল। এই অভ্যুত্থানে ছাত্র–জনতার দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়ে আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একাধিক সমাবেশ, পদযাত্রা ও লংমার্চে শামিল হয়েছি।’ লিখিত বিবৃতিতে বলেছেন শিল্পী–আলোকচিত্রীরা।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী সব হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও বিচার বিভাগীয় নিরপেক্ষ তদন্তের জোর দাবি তুলেছেন তাঁরা। একই সঙ্গে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সব আহত নাগরিকের সুষ্ঠু চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও নিরাপত্তার জোর দাবি তোলা হয়েছে।
যৌথ বিবৃতি পাঠের পর বক্তব্য দেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা কালের সাক্ষী, এই ক্রান্তিলগ্নে অনেক কিছুই হচ্ছে যেগুলো ধরে রাখা দরকার। অনেকগুলো হয়েছে, যেগুলো আমরা ধরে রেখেছি। একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, যেটার অনেক ধরনের অপব্যাখ্যা হচ্ছে, হবে। আমরা সেটাকে প্রতিহত করার চেষ্টা করছি।’
বিক্ষুব্ধ নাট্যকর্মী ব্যানারের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেন নাট্যশিল্পী রোকসানা রুমা। অন্তত পাঁচটি থিয়েটার প্রযোজনাকে আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা, দলীয় বিবেচনায় শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালনা নিয়োগ না দেওয়া, থিয়েটারকর্মী ও কলাকুশলীদের মাসিক ভাতা দেওয়াসহ ৯টি দাবি তুলে ধরেছেন তিনি।
বাংলাদেশ সংগীতশিল্পী সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তব্য দেন সোনার বাংলা সার্কাস ব্যান্ডের ভোকালিস্ট প্রবর রিপন।
তিনি বলেন, ‘গত ১৬ বছর মেটাফোরিক ভাষায় গান করতে করতে এমন জায়গায় চলে গেছি, নিজেই নিজের গান, কবিতা বুঝি না। ভাবতে হয় মুখোশটা ঠিক আছে কি না। এখন সময় এসেছে, যা বলতে চাই সেটাই বলার। আমরা চাই, এখনকার ক্ষমতাসীনদের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা যেন করতে পারি। সরকারবিরোধী, ফ্যাসিজমবিরোধী, অন্যায়বিরোধী গান গাওয়ার জন্য যেন হান্নানের মতো কাউকে গ্রেপ্তার করা না হয়।’
প্রবর রিপন বলেন, ‘আমরা সংগীতশিল্পীরা বহুদিন ধরে কথা না বলতে বলতে আমরা ভুলে গেছি, কী কথা বলতে হয়। র্যাপাররা দেখিয়ে দিয়েছে, কীভাবে মানুষের পাশে সময়মতো দাঁড়াতে হয়। রাষ্ট্রের কাছে আমরা কিছু চাই না, শুধু স্বাধীনতা চাই। যে গান গাইতে চাই, যে লেখা লিখতে চাই, যে সিনেমা বানাতে চাই; রাষ্ট্র কোনো বাধা দেবে না। যদি বাধা দেন, এই শহীদেরা তরুণদের শিখিয়ে দিয়ে গেছে, কীভাবে দাঁড়াতে হয়।’
দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজের পক্ষে বক্তব্য দেন কস্টিউম ডিজাইনার ইদিলা ফরিদ তুরিন। স্বাধীন ফিল্ম কমিশন গঠন করা, চলচ্চিত্রকে সেন্সরমুক্ত করা, সময়োপযোগী ও আধুনিক ফিল্ম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা, সিনেমা হল মেরামত করে প্রদর্শনী উপযোগী করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
অভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেওয়া, আলোচিত্রীদের কাজে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আলোকচিত্রী শহিদুল আলমসহ সব আলোকচিত্রী ও সাংবাদিকের ওপর থেকে দমনমূলক আইন প্রত্যাহারের দাবি তুলেছেন আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতার।
শিল্প–সংস্কৃতি সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম। শিল্পী–সমাবেশের সঞ্চালনা করেন আলোকচিত্রী আমিরুল রাজীব। আরও উপস্থিত ছিলেন অমিতাভ রেজা, সুমন আনোয়ার, বাঁধন, মম, অর্ষাসহ অনেকে।
সমাবেশের পর শহীদ মিনারে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ পরিবেশন করেন তানযীর তুহিন, আরমীন মুসা, লাবিক কামাল, প্রবর রিপনসহ উপস্থিত শিল্পীরা।