১.
নব্বই দশক— আমাদের মনে সারাজীবন দাগ কাটবে। কত না সোনালি ছিলো দিনগুলো। আহা! কত শত কালজয়ী সিনেমা, ডায়ালগ, তারকাদের লাইফস্টাইল, ফ্যাশন, বিজ্ঞাপন সবকিছুই যেন এক জাদুর পরশ। যা দেখতাম তাই ভালো লাগতো। হা করে টিভির সামনে বসে গিলতাম সব।
মনে পড়ে কি নিরমা সাবানের বিজ্ঞাপনচিত্রের থিম সং— ওয়াশিং পাউডার নিরমা, ওয়াশিং পাউডার নিরমা…।
ঘড়ি ডিটারজেন্টের— পেহেলে ইস্তেমাল কারে, ফির বিসওয়াস কারে কিংবা শাহরুখের— ‘কা কা কা কিরান’ বা সিনেমাটার ‘জাদু তেরি নাজার,খুশবু তেরা বাদান/তু হা কার ইয়া না কার তু হ্যা মেরি কিরান’। এর সবই মুখস্থ বুলি।
রাভিনার ‘তু চিজ বারি হে মাস্ত মাস্ত’ তো রোজকার নাচানাচিতে ছিলই। নায়ক-নায়িকাদের বিশাল পোস্টার দিয়ে দেয়াল সাজায়নি এমন লোক খুঁজে পাওয়া যাবে না হারিকেন দিয়েও। আর তারকাদের ভিউ কার্ড সংগ্রহ করা তো রীতিমত প্রতিযোগীতা ছিল স্কুলে— কার কত বেশি…। হাহাহা।
২.
দিব্যা ভারতী নামের অপ্সরী নব্বই দশকের সফল অভিনেত্রী এবং রহস্যকন্যা। তিন বছরের ক্যারিয়ারে দিয়েছেন অসংখ্য হিট সিনেমা, ছিলেন সর্বাধিক পারিশ্রমিকপ্রাপ্তদের একজন। ক্ষণজন্মা এ অভিনেত্রী অনেক রহস্যের জন্ম দিয়ে ওপারে পাড়ি জমান মাত্র ১৯ বছর বয়সে।
পুরো নাম দিব্যা ওম প্রকাশ ভারতী। ১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি,মুম্বাইতে জন্ম। বাবার দ্বিতীয় ঘরের বড় সন্তান এবং ছোট এক ভাই নিয়েই ভালোই চলছিলো শৈশব । জানিয়ে দেই, ‘গ্রান্ড মাস্তি’ সিনেমার অভিনেত্রী কায়নাত আরোরা তার কাজিন।
পড়াশোনায় ছিলেন মোটামুটি লেভেলের। বাবা-মার অতি আদরের মেয়ে ৯ম শ্রেণীতে পড়াকালীন সিনেমার রঙিন দুনিয়ায় আসার ইচ্ছে পোষণ করেন। ফলাফল পড়াশোনা লাটে। মনোযোগ দেন অভিনয় জগতের চকচকে দুনিয়ায়। তখনো বুঝতে পারেননি এত সহজ নয় এই জগত।
বিভিন্ন জায়গায় অডিশন দিয়েও কোন লাভ হচ্ছিলো না। এরকম সময়ে একদিন ‘গুণাহ কা দেবতা’-তে এক্সটেন্ডেন্ট রোল পান। মন প্রাণ উজার করে অভিনয় করলেন। কিন্তু সিনেমা মুক্তির দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে হলে গিয়ে দেখেন তার অভিনীত দৃশ্যটি কেটে দেয়া হয়েছে।
এতটাই কষ্ট পান যে জেদ চেপে আবারও শুরু করেন অডিশন দেয়া। এবার সুযোগটা আসে সুপারস্টার গোবিন্দর বড় ভাই কীর্তি কুমারের হাত ধরে। ১৯৮৮ সালে ‘রাধা কা সঙ্গম’ -এ গোবিন্দর সাথে প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের কথা চূড়ান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত সেই সময়ের অন্যতম লেডি সুপারস্টার জুহি চাওলা রোলটা প্লে করেন।
বারবার যখন ভাগ্য তাকে হারিয়ে দিচ্ছিলো,ঠিক সেই সময়ে তেলেগু সিনেমা সফল পরিচালক ডি রামানাইদু ‘বুবলি রাজা (১৯৯০)’ সিনেমায় ভেঙ্কেটেশের সাথে সুযোগ দেন। এতদিনের প্রত্যাখান আর অভিনের ক্ষুধায় সেই বছরের সেরা তেলেগু সিনেমা হয়ে যায় এটি। সাথে সাথে দিব্যার ভাগ্য ঘুরে যায়।
তামিল-তেলেগু সিনেমায় সফলতা পেতে থাকলেও তার আসল জায়গা যে বলিউড সেটা বেশ ভালো করেই মনে রেখেছিলেন। কপালটা আর একবার ঝালাই করার জন্য অডিশন দেন ‘বিশ্বাত্মা’র জন্য। সানি দেওলের সাথে অভিনয় প্রশংসিত হলেও ভালো ব্যবসা করেনি করেন সিনেমাটি। তবে ‘সাত সমুন্ধর পার মে তেরে পিছে পিছে আ গেয়ি’ গানটি দিব্যাকে এনে দেয় তারকাখ্যাতি।
লরেন্স ডি’সুজা তার ‘দিল কা ক্যায়া কাসুর’-এ তাকে নায়ক পৃথিবীর সাথে নেন। সিনেমাটির গান হিট হলেও বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। আবারো ভাগ্যের কাছে অহসায় দিব্যা। সিদ্ধান্ত নিলেন তেলেগু সিনেমায় ফিরে যাবার।
৩.
‘কিসি চিজ কো আগার দিল সে চাহো তো পুরি কায়নাত উসে তুমসে মিলানেকি কোসিস মে লাগ জাতি হে’—শাহরুখের বিখ্যাত সংলাপটি দিব্যার কপালের সাথে খুব মিলে যায়।
দিব্যার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট— ডেভিড দেওয়ানের ‘শোলা অর শবনম’। সিনেমাটিতে গোবিন্দর সঙ্গে আসে বলিউডের প্রথম হিট। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। যেই জুহি চাওলার জন্য প্রথম সিনেমাতে তার রোল সাইডলাইন হয়ে গিয়েছিলো সে জুহির সামনেই একের পর এক ম্যাগাজিনের কভার গার্ল হয়েছেন, দিয়েছেন সাক্ষাতকার। সত্যি ভাগ্য বদলাতে সময় লাগে না কথাটা প্রমাণ করে দিলেন দিব্যা।
শাহরুখ জানতে পারেন তার অভিষেক সিনেমা ‘দিওয়ানা (১৯৯২)’তে এক বিধবা নারীর প্রেমিক হিসেবে কাজ করবেন—কিছুটা ঘাবড়ে যান। কারণ, নায়িকার বয়স নিয়ে শংকা। কিন্তু সেটে ১৭ বছরের মিষ্টি হাসির দিব্যাকে দেখে সব বেমালুম ভুলে যান তিনি। সিনেমা হয় ব্লকবাস্টার। সিনেমাটির ‘তেরা নাম লিখ দিয়া’ গানটি আজো অনেকের প্লে-লিস্টে বাজে।
সুনিল শেঠির অভিষেক সিনেমা ‘বলবান’-এর নায়িকা হিসেবে আরো একটি সফল সিনেমা উপহার দেন দিব্যা।
এরপর ‘জান সে পেয়ার’, ‘গীত’, ‘দুশমন জামানা’সহ হিটের সংখ্যা ও বাড়তে থাকে তার। মাঝে শাহরুখের সাথে ‘দিল আশনা হ্যায়’ করলেও হিট হয়নি। এরপর মাল্টিস্টারার সিনেমা ‘ক্ষত্রিয়’ তে সানি দেওল, রাভিনা এবং সঞ্জয় দত্তের সাথে দেন আরো একটি হিট।
৪.
নায়িকা হলে নায়কদের সাথে লিংকআপের নিউজ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সদ্য কৈশোরে পা দেয়া দিব্যা এসবের কিছুই ধার ধরতেন না। কাজের জন্য ছিলো তার জান-প্রাণ। আর হবেই বা না কেন, বড্ড কষ্ট করে যে পেয়েছিলেন সফলতা।
তখন চলছিলো ‘শোলা অর শবনম’-এর শুটিং। গোবিন্দের সাথে দেখা করতে এলেন এক বন্ধু। বন্ধুটির সাথে ক্ষণিকের আলাপ মনে গেঁথে গেলো দিব্যার। নিয়মিত যোগাযোগ হতে থাকলো।
প্রেম যে মানে না কোন বাধা বয়স কিংবা ধর্ম— আবারো প্রমাণ করলেন তিনি। ১০ মে,১৯৯২ তে সবার অজান্তে বিয়ে করে ফেলেন বন্ধুটিকে। মানুষটা আর কেউ না,আজকের সফল প্রযোজক সাজিদ নাদিয়াতওয়ালা। বিয়েতে সাক্ষী হিসেবে ছিলেন দিব্যার হেয়ারড্রেসার।
সাজিদ বিবাহিত হওয়া স্বত্বেও ঘর বাঁধতে দ্বিতীয় বার ভাবেননি দিব্যা। ক্যারিয়ারের স্বার্থে বিয়ের বিষয় গোপন থাকে। যদিও কেউ কেউ জানত ব্যাপারটা। সাজিদ মুসলমান বিধায় নাম পাল্টে হয়ে যান সানা নাদিয়াতওয়ালা। স্বামীর ভারসোভা এলাকার ফ্ল্যাটে শুরু তার হয় নতুন জীবন।
কিন্তু ভাগ্যদেবতা বেশিদিন সহায় হয়নি তার। সব বদলে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। সাজিদ সন্দেহ করেন দিব্যা প্রেম করছেন এক নায়কের সাথে। অন্যদিকে দিব্যাও খবর পান আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে সাজিদের শক্ত যোগাযোগ রয়েছে। এসব নিয়ে সবসময় ঝগড়া চলতো। কিন্তু কাজে কখনো প্রভাব পড়তে দিতেন না তিনি—সেটে সবসময় মুখে হাসি লেগেই থাকত।
৫ এপ্রিল,১৯৯৩। চেন্নাই থেকে শুটিং শেষ করে বাড়িতে আসেন দিব্যা। রাত ১০ টা নাগাদ বিখ্যাত ডিজাইনার ও তার কাছের বান্ধবী নিতা লুল্লা আসেন কিছু ডিজাইন নিয়ে। পায়ে ব্যাথা পাওয়ার কারণে মন মেজাজ কিছুটা বিগড়ে ছিলো। কাজের মহিলার সাথে রাগারাগি করেন। নিতাকে ড্রিংক দিয়ে নিজেও এক গ্লাস হাতে নিয়ে শোবার ঘরে যান। সেখানকার বড় খোলা জানালাটি ছিলো তার খুবই পছন্দের। অনেকের বয়ান মতে এই জানালার সাইডে বসতে গিয়ে ব্যালেন্স হারিয়ে ৫ তলা থেকে নিচে পড়ে যান দিব্যা। হাসপাতালে নেয়ার পথেই মৃত্যু হয়।
এরপর অনেক সত্য-মিথ্যা— আত্মহত্যা,সাজিদের পরিকল্পিত হত্যাকান্ডসহ নানা গুঞ্জন ছড়াতে থাকে। কেউ বান্ধবী নিতা লুল্লাকেও দোষ দিয়েছে,কেউবা এতে আন্ডারওয়ার্ল্ডের হাতও দেখেছে।
কাকতালীয়ভাবে কাজের মহিলাও তার মৃত্যুর ঠিক একমাস পরে মারা যায়। অপরাজিতা এ সুন্দরীর মৃত্যুরহস্য পাঁচ বছরেও সুরাহা করতে না পেরে ‘দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যু’ হিসেবে পুলিশ মামলার ফাইল ক্লোজ করে দেয়।
৫.
তার মৃত্যুতে অনেক প্রযোজকদের মাথায় হাত পড়ে। ‘লাডলা’ তে অনিল কাপুরের সাথে আশি শতাংশ কাজ শেষ করেন দিব্যা। তার মৃত্যুতে শ্রীদেবি অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করেন। তার সাইন করা— ‘মোহরা’, ‘কর্তব্য’, ‘বিজয়পথ’, ‘আন্দোলন’ বক্স অফিসে হিট সিনেমাগুলোতে অন্য নায়িকারা কাজ করেন।
বেঁচে থাকলে হয়ত সেই সময়ের সব নায়িকাদের রাতের ঘুম হারাম করে দিতেন এটা নিশ্চিত। তখনকার সময়ে দুবাই,নিউইয়র্কসহ বিশ্বের বড় বড় শহরগুলোর স্টেজ শোতে অংশ নিতেন দিব্যা। তার পারিশ্রমিকও ছিলো অন্যান্যদের তুলনায় অনেক বেশি।
মাত্র ১৯ বছর বয়সে ঈর্ষণীয় সাফল্যের অধিকারী এ রহস্যকন্যার চলে যাওয়া কেউ মেনে নিতে পারেনি। ছোট্ট বলিউড ক্যারিয়ারে সিনেমা ছিল তেরোটি—৩টি সুপারহিট,২টি হিট এবং ৩টি এভারেজ। পেয়েছিলেন ফিল্মফেয়ার নিউ ডেবিউ এবং লাক্স নিউ ফেইস অ্যাওয়ার্ড।
তার সেই ভুবন ভুলানো হাসি আমি আজো ভীষনভাবে মিস করি। সেই হাসিতে খুঁজে পেতাম এক ছোট বাচ্চাকে। তার ছবির দিকে তাকিয়ে একটা মেয়ে কী করে এত মায়াবী হয় তাই ভাবতাম।
আজো তার সিনেমার গানগুলো আমার ফোনে ‘মিস্টেরিয়াস গার্ল’ নামক ফোল্ডারে আলাদাভাবে স্থান পায়। সবগুলো গান শুনি প্রায়ই এবং ভীষন ভাবে মিস করি এই মায়াভরা মুখটা। ওপারে না গেলে কি একদম-ই হতো না?
বিঃদ্রঃ লেখাটি ‘তারকা সংবাদ প্রেজেন্ট জাস্ট বলিউড রাইটিং কনটেস্ট ২০১৮’-এ দ্বিতীয় পুরস্কার পেয়েছে।