শিল্পকলায় চলচ্চিত্র বিভাগ চেয়ে যেসব যুক্তি দিলেন ১৭৫ বিশিষ্টজন

বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইনের সংশোধিত খসড়া থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘চলচ্চিত্র’ উপবিভাগ। এর প্রতিবাদ জানিয়েছেন চলচ্চিত্র সংশিষ্ট ১৭৫ বিশিষ্টজন। শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্রের জন্য পৃথক বিভাগের দাবি জানিয়েছেন তারা।

আজ (২৪ নভেম্বর) রোববার নিজেদের দাবির পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে একটি বিবৃতি দিয়েছেন বিশিষ্টজনেরা। তাদের মধ্যে রয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ও প্রযোজক, চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, শব্দগ্রাহক ও কলাকুশলী, চলচ্চিত্র সমালোচক, গবেষক, শিক্ষক, চলচ্চিত্রকর্মী ও সংগঠক, অভিনয় ও সংগীতশিল্পী ও আলোকচিত্রী।
বিবৃতিতে তারা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন, ১৯৮৯-এর অধিকতর সংশোধনকল্পে প্রণীত অধ্যাদেশ’-এর খসড়ায় আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছি, পূর্বের ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র’ উপবিভাগ থেকে ‘চলচ্চিত্র’ অংশটুকু বাদ দেওয়া হয়েছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি, বরং চলচ্চিত্রকে পৃথক এক বিভাগ করার জন্য দাবি জানাচ্ছি।

গণঅভ্যুত্থানের পরে যখন নতুন সময়ে গণঅভ্যুত্থানকে ও মানুষের মুক্তিমুখীন লড়াইকে ধারণ করা এবং চলমান দেশগঠন ও সংস্কার প্রক্রিয়ায় পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ, এই নবজাগরণকে সবচেয়ে ভালোভাবে ধারণ করতে পারে যে মাধ্যম, শিল্পকলার অন্যতম সেই শাখা চলচ্চিত্রকে একাডেমি থেকে বাদ না দিয়ে বরং স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হোক। কারণ জাতির বর্তমান প্রত্যাশা ও প্রয়োজনকে ছোট-বড়-প্রমাণ্য-ফিচার ইত্যাদি নানাধর্মী চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে ধারণ করবে যে নতুন প্রজন্মের নির্মাতারা, তার পৃষ্ঠপোষকতা বাণিজ্যিক আবহ করবে না, জাতীয় প্রতিষ্ঠান শিল্পকলা একাডেমিই সেই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারে। একাডেমির সব জেলার শাখাগুলোয় এসব চলচ্চিত্রের ধারাবাহিক প্রদর্শন চলতে থাকবে, এটাই চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্টদের আকাঙ্ক্ষা।

শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্রবিষয়ক কার্যক্রম স্বাধীনতার পর থেকেই রয়েছে। ১৯৭৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন জাতীয় সংসদে পাস হওয়ার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালের আইনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পাঁচটি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এই পাঁচ বিভাগ ছিল – চারুকলা, নাট্যকলা, সঙ্গীত ও নৃত্যকলা, চলচ্চিত্র (সিনেমাটোগ্রাফি),গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগ। অর্থাৎ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির শুরু থেকেই পৃথক ‘চলচ্চিত্র বিভাগ’ ছিল। প্রতিষ্ঠার ১৫ বছর পর ১৯৮৯ সালে তৎকালীন সরকার ১৯৭৪ সালের বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন রহিত করে ‘বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯’ জারি করে।

১৯৮৯ সালের এই আইনে চলচ্চিত্র বিভাগ বাদ দেওয়া হয় এবং এই আইনে চলচ্চিত্রকে বাদ দেওয়ার বিরোধিতা করে চলচ্চিত্রকর্মীরা প্রতিবাদ জানান। তাদের প্রতিবাদের পরিপ্রেক্ষিতে পরে শিল্পকলা একাডেমি পরিষদ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি আইন ১৯৮৯ এর ৮ নং ধারার ২ নম্বর উপধারার অধিকার বলে চলচ্চিত্রকে নাট্যকলা বিভাগের সাথে যুক্ত করে ‘নাট্যকলা ও চলচ্চিত্র বিষয়ক বিভাগ’ গঠন করে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু থেকেই ‘চলচ্চিত্র’ তার অংশ হয়ে আছে। তাই ঐতিহ্য ও অধিকারের বিচারে, আজও শিল্পকলা একাডেমি থেকে চলচ্চিত্রকে বিদায় করে দেওয়ার সুযোগ নেই।

চলচ্চিত্র একটি সমন্বিত শিল্পকলা, সব মাধ্যম থেকে ধার করে বিংশ শতাব্দি থেকেই সে অন্যতম শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম হয়ে উঠেছে। সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্রকার হওয়ার আগে ছবি আঁকতেন, ঋত্বিক ঘটক বা ইঙ্গমার বার্গম্যান প্রথমে থিয়েটার করতেন। জহির রায়হান সাহিত্যিকও ছিলেন, চলচ্চিত্রকারও ছিলেন। আলমগীর কবির সাংবাদিকতার পাশাপাশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। অনেকে ফটোগ্রাফি বাদ দিয়ে সিনেমাটোগ্রাফি শুরু করেছেন।
একটা যুক্তি বরাবরই ছিল, চলচ্চিত্র দেখার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় আছে। তথ্য মন্ত্রণালয় দেখে চলচ্চিত্রের কারখানা (এফডিসি), সেন্সর ও সনদ, প্রশিক্ষণ (বিসিটিআই), সরকারি তথ্যচিত্র (ডিএফপি), চলচ্চিত্রের আর্কাইভ।

কিন্তু এত কিছু থাকার পরও স্বাধীনতার পর থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে চলচ্চিত্র উপবিভাগ ছিল। কারণ শিল্পকলা বা আর্ট হিসেবে চলচ্চিত্রকে দেখার কোনো প্রতিষ্ঠান তথ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল না। তাই শিল্পকলা একাডেমিতে বহু বছর ধরেই চলিচ্চত্রের শিল্পকলার দিকটি চর্চিত হয়ে আসছে। এখানে চলচ্চিত্রবিষয়ক ওয়ার্কশপ, ফিল্ম ফেস্টিভাল, পাঠচক্র আয়োজিত হয়েছে। চলচ্চিত্র কার্যক্রম সীমিত আকারে হলেও সারা দেশে একাডেমির সব শাখায় চালু হয়েছিল। এমনকি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা এরকমও প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিলেন যে, একাডেমির সব শাখায় মিনি মাল্টিপ্লেক্স গড়ে তুলতে, তাতে প্রেক্ষাগৃহের সংকট কমবে।

বলা যায়, সম্প্রতি ফিল্ম সোসাইটি ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট নির্মাতাদের যাবতীয় কার্যক্রম শাহবাগ থেকে শিল্পকলায় স্থানান্তরিত হয়েছিল। যারা চলচ্চিত্রের শিল্পকলার দিকটি নিয়ে চর্চা করেন, ফিল্ম সোসাইটিগুলো, ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটি, শর্ট ফিল্ম ফোরাম, তরুণ ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকার, সবার পদচারণার ক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল একাডেমি। দুবছর পরপর যে ইন্টারন্যাশনাল শর্ট ও ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভাল হয়, বা রেইনবোর ঢাকা ফিল্ম ফেস্টিভাল, তারও অন্যতম ভেন্যু ছিল একাডেমি। শিল্পকলার মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র, এই সংস্থাগুলোয় ও এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে চর্চিত হতো।

তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিষ্ঠান এফডিসি, ডিএফপি বা সেন্সর বোর্ডে এই চর্চা খুঁজে পাওয়া যাবে না। চলচ্চিত্রে সাম্প্রতিক সময়ে নবজাগরণ দেখা যাচ্ছে, মূলধারার এফডিসির চলচ্চিত্র গৌরব হারালেও, ওটিটি বা স্ট্রিমিং প্লাটফর্মগুলোয় নতুন ও স্বাধীন নির্মাতারা বৈচিত্র্যময় কাজ করছেন, অনেকক্ষেত্রে বিদেশ থেকে গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারও অর্জন করছেন।

তাদের প্রত্যাশা, শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হবে এবং নবনিযুক্ত সংস্কৃতি উপদেষ্টা এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। পাশাপাশি তারা এ দাবিও করেছেন যে, প্রয়োজন অনুযায়ী সরকার সংস্কৃতি নীতিমালারও প্রয়োজনীয় পরিমার্জনা করবে।
বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন যারা: বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন নির্মাতা ও প্রযোজক তাসমিয়াহ আফরিন মৌ, নূরুল আলম আতিক, আবু সাইয়ীদ, এন রাশেদ চৌধুরী, আকরাম খান, শবনম ফেরদৌসী, টোকন ঠাকুর, নোমান রবিন, ওয়াহিদ তারেক, প্রসূন রহমান, রেদওয়ান রনি, খিজির হায়াত খান, পলাশ রসুল, তানিম নূর, খন্দকার সুমন, শঙ্খ দাশগুপ্ত, লিটন কর, কৃষ্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়, মোহাম্মদ আলী হায়দার, এহসানুল হক বাবু, উত্তম কুমার সিংহ, হুমায়ুন কবীর শুভ, পার্থ সেন গুপ্ত, আরিফ সনেট, মানস মেহেদী, আদনান বাঙালী, আসাদ জামান, সুকর্ণ শাহেদ ধীমান, ধ্রুব হাসান, আদনান হাবিব, মোঃ আবুল কালাম আজাদ, তানহা জাফরীন, শ্যামল শিশির, ইয়াছির আল হক, ফরিদ আহমদ, জায়েদ সিদ্দিকী, রিয়াজুল রিজু, ফেরদৌস কোরেশী, স্বজন মাঝি, জাহিদ হাসান, শারমিন দোজা, কামরুল হাসান, শুভ্র খান, শাহ তুষার, অন্তু আজাদ। চিত্রগ্রাহক, সম্পাদক, শব্দগ্রাহকসহ কলাকুশলীদের মধ্যে রতন পাল, তানভীর আলম সজীব, চৈতালী সমদ্দার, নাভিদ খান চৌধুরী, সমালোচক, গবেষক, শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ফাহমিদুল হক, আ-আল মামুন, বিধান রিবেরু, ইমরান ফিরদাউস, আমিরুল রাজিব, ওয়াহিদ সুজন, ড. সেলিম মোজাহার, সাদিয়া খালিদ রীতি, জাহিন ফারুক আমিন, ধ্রুব সাদিক, মো. সাজেদুল ইসলাম, জাহাঙ্গীর আলম, আনান সিদ্দিকা, শেখর দাশ, সাইয়্যিদ শাহজাদা আল কারীম, ড. মুহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন।

চলচ্চিত্রকর্মী ও সংগঠকদের মধ্যে রয়েছেন মুনিরা মোরশেদ মুন্নী, তারেক আহমেদ, কাজী মামুন হায়দার, ড. সাজ্জাদ বকুল, মোহাম্মদ রোমেল, রাকিবুল হাসান, মেহেদী হাসান, ইব্রাহিম খলিল, আব্দুর রহমান, লোকপ্রিয় বড়ুয়া, বৈশাখী সমদ্দার, সৈয়দ ইমরান হোসেন কিরমানী, আনন্দ কুটুম। স্বাক্ষরকারী অভিনয়শিল্পী ও সংগীতশিল্পীরা হলেন জাকিয়া বারী মম, রওনক হাসান, দীপক সুমন, সোহেল মন্ডল, নাহিদা শারমিন (শর্মীমালা), আব্দুল্লাহ আল সেন্টু, তানভীর আহমেদ ও আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published.