এই লেখাটা যখন আমি লিখছি, তখন আমার শরীরের জ্বরের পরিমাণ ১০১ ডিগ্রী। কিন্তু লেখাটা না লিখে আমি থাকতে পারছি না বলেই লেখা।
জ্বর, তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর।
আমি যা লিখব, সেটা কোন সিনেমার রিভিউ না, প্রিভিউ না। কারো জীবনী না। সিনেমার পেছনের অজানা কাহিনি না। নায়ক-নায়িকার স্ক্যান্ডাল না। তাহলে লিখবটা কী আসলে? আমি লিখব আমার দুইজন ফ্রেন্ডের কথা, যাদের জীবনে দুটো হিন্দি সিনেমা বেশ প্রভাব ফেলেছিল। সিনেমার শক্তিটা কতটুকু, আশা করি এই লেখা সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা দিবে। আর হ্যাঁ, দুটো ঘটনাই সত্যি ঘটনা। আর সঙ্গত কারণেই আমার সেই দুই বন্ধুর নাম প্রকাশ করব না।
দুটো হিন্দি সিনেমা হচ্ছে— ‘ওম শান্তি ওম’ আর ‘কিউকি’।
একটা শাহরুখ খানের, আরেকটা সালমান খানের সিনেমা। এই দুইজনকে অথবা দুইজনের একজনকে আপনি পছন্দ নাই করতে পারেন, ভালো নাই বাসতে পারেন, তবে এটা তো অস্বীকার করতে পারবেন না যে তারা দুইজন বলিউডের দুই স্তম্ভ। শূন্য থেকে শাহরুখ খানের এই পর্যায়ে আসা, মাইক হাতে যেকোনো জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলে নিজের সেন্স অফ হিউমারের মাধ্যমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে যাওয়া, নিজের ফ্যামিলির প্রতি দায়বদ্ধ থাকা আর নিজের বাচ্চাদের ভালোবাসা, প্রেমিক পুরুষ টার্মটাকে একদম নিজের ‘ব্র্যান্ড’ করে ফেলা— ভালোলাগার কারণের তো শেষ নাই।
শুধু নিজের শার্টের কলার ঝাঁকিয়ে বা বেল্ট নাড়িয়ে বক্স অফিসে ঝড় তোলা, একের পর এক ব্লকবাসটার দেয়া, ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’ আর ‘সুলতান’-এর মতো সিনেমা দিয়ে নিন্দুকদের একদম চুপ করিয়ে দেয়া, বলিউডে একের পর এক নতুন ট্যালেন্ট নিয়ে আসা, ‘বিইং হিউম্যান’ দিয়ে মানুষকে সাহায্য করা, ফিটনেস ফ্রিক— কতই না ভালোলাগার কারণ সালমান খান।
কিন্তু যে দুটো সিনেমার নাম আমি বললাম— সেগুলো কি তাদের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা সিনেমা বা পারফর্মেন্স? আমার মনে হয় বেশিরভাগই বলবেন, না তো।
‘ওম শান্তি ওম’ এমন সময়কার সিনেমা, যখন শাহরুখ মানেই সাফল্য। সেই সময়ের বক্স অফিস কাঁপিয়ে দিয়েছিল। অপরদিকে ‘কিউকি’ এমন সময়ের যখন সালমানের ক্যারিয়ারের অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না। স্বাভাবিকভাবে বক্স অফিসেও সফল হয়নি। তবে তার মারদাঙ্গা সিনেমাগুলোর চাইতে একেবারেই আলাদা।
আমার প্রথম বন্ধুর কথা বলি— তার বাবা-মার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ‘ওম শান্তি ওম’ সিনেমার রিলিজের বছরে। সে খুবই ডিপ্রেসড। যতই তাকে বুঝানোর চেষ্টা করি, খুব একটা কাজ হয় না। ভয়ে থাকি, পাছে সুইসাইড না করে ফেলে বা মাদকের দিকে না চলে যায় আবার। বললাম, নিজেকে সময় দে, ভালো বই পড়, ভালো সিনেমা দেখ, ধৈর্য ধর।
ওইসময়ে একদিন তার সাথে দেখা। চোখমুখ দেখেই বুঝলাম, প্রচণ্ড এক্সাইটেড। আমি বললাম, কী হইসে রে? সে বললো, দোস্ত, থ্যাংকস সিনেমা দেখতে বলার জন্য। একটা সিনেমা আমার ভাবনা চিন্তা বদলায় দিসে বলতে গেলে। মনে হয় বাবা মাকে আবারও ফিরে পাব।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কোন সিনেমা? ক্যামনে কী?
সে বললো, ওম শান্তি ওম!
আমি ভাবলাম, অতি দুঃখে পাগল হয়ে গেল নাকি! এটি কমার্শিয়াল সিনেমা, বলিউডের আর দশটা সিনেমার মতই। ভালো কিছু গান আছে, পুনর্জন্মের কাহিনি, শাহরুখ খানের সিক্স প্যাক— এই তো! আর কী আহামরি পাইল সে?
আমার মুখ পড়েই মনে হয় সে বললো, দোস্ত, এই সিনেমাতে শাহরুখ খান একটা ডায়লগ বলে— ‘আগার কিসি চিজ কো দিল সে চাহো, তো পুরে কায়নাত…।’
আমি বললাম,জানি এটা। তো?
সে বললো, এই সংলাপটা দোস্ত আমাকে খুব ইন্সপায়ার করছে। শাহরুখ যেমনে বলসে সিনেমাতে কথাটা, আমার জাস্ট মনে হইসে আমি চাইলে সব সম্ভব। যে কেউ চাইলে সম্ভব যদি যে চেষ্টা করে।
বিশ্বাস করবেন কিনা জানিনা, পরের বছরই তার সেই ডিভোর্স হয়ে যাওয়া বাবা মা আবার একত্র হয়ে যান। আর এখন পর্যন্ত তারা সুখেই আছেন। আর এর সবটা হইসে আমার সেই ফ্রেন্ডের কারণে। আর সে বলে, সব হইসে শাহরুখ খানের ‘ওম শান্তি ওম’-এর কারণে।
প্রসঙ্গত, সে শাহরুখ খানের ফ্যান না। শাহরুখের ভাল সিনেমার কথা বললে আমরা যখন ‘ডর’, ‘বাজিগর’, ‘চাক দে’, ‘স্বদেশ’ বা ‘মাই নেম ইজ খান’-এর কথা বলি তখন সে শুধু ‘ওম শান্তি ওম’-এর কথা বলে। আর চোখে পানি এনে বলে, দোস্ত, এই লোকটার এই সিনেমার কারণে বাবা-মাকে আবার একসাথে ফিরে পাইসি। আমি সিনেমা বুঝি না এত, আমার কাছে ‘ওম শান্তি ওম’-ই শাহরুখ খানের বেস্ট সিনেমা।
দ্বিতীয় ফ্রেন্ডের কথায় আসি। বাবা মার চাপে পড়ে সে ডক্টর হইসে অনেক পড়াশুনা করে, যদিও রক্ত দেখলে বা তেলাপোকা দেখলেই তার হাত পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। যতই কাঁপুক, কিছু করার নাই। পড়াশুনা তো করতেই হবে। অনেকটাই জোর করে পড়তে থাকলো সে। এরকম একটা সময় ‘কিউকি’ নামের একটা সিনেমা তার জীবনটা পাল্টে দেয় অনেকটাই।
এই সিনেমা দেখার পর প্রথমবারের মতো তার মনে হল, একজন রোগীর জীবনে আসলে কত কাহিনি থাকে। বিশেষ করে যারা মানসিকভাবে অসুস্থ, সেইসব রোগীদের জন্য অদ্ভুত একটা মায়া জাগল তার মধ্যে, সাথে মায়া জাগল পেশাটার জন্যও। আর কারণ? অবশ্যই ভাইজান!
এই সিনেমা দেখে ইচ্ছেমত সে নিজের মুগ্ধতা আমার কাছে প্রকাশ করে। আমি বলি, সিনেমাটা তো মালায়ালাম সিনেমার রিমেক। আর মূল কাহিনী নেয়া হইসে জ্যাক নিকলসনের ‘ওয়ান ফ্লিউ ওভার দি কাকুজ নেস্ট’ থেকে। ঐ দুইটা তো ‘কিউকি’র চেয়েও ভালো। কিন্তু কোন কথাই তার কানে যায় না। ‘বাজরাঙ্গি ভাইজান’, ‘সুলতান’, ‘তেরে নাম’ নিয়ে তার মুখে তেমন কথা নাই। কিন্তু ‘কিউকি’র নাম বললেই তার চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে।
আগের বন্ধুটির মত সেও সালমান খানের এমন কোন ফ্যান না। এরচেয়ে আশ্চর্যের একটা ব্যাপার আছে, সিনেমাটি দেখার পরে সে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রোগীদের সেবা করার চেষ্টা করবে আর এই কারণেই সে পরে নিউরোলজি নিয়ে পড়াশুনা করতে বিদেশ চলে যায় স্কলারশিপ পেয়ে। সবকিছুর মূলে কারণ একটাই— কিউকি।
এই দুইটা ঘটনা খুব বেশি আগের না। আমার এই দুই ফ্রেন্ডের সাথে অনেকদিন আমার যোগাযোগ নাই। ফেসবুকেও তারা একটিভ না। কিন্তু এই দুইজন আমাকে যে শিক্ষাটা দিয়ে গেসে, সেটা সম্ভবত শাহরুখ-সালমানের অন্ধভক্তদের মধ্যেও আমি পাই নাই। সেটা হচ্ছে, একটা সিনেমা কার কীভাবে ভালো লাগবে, সিনেমা কাকে কীভাবে ছুঁয়ে যাবে— সেই বিষয়ে আমাদের কোন আইডিয়া নাই।
যে সিনেমাকে হয়ত আমি সাকিব বা আপনি বা অনুপমা চোপড়া বা রাজিভ মাসান্দ বা রজার অ্যাবারট ১০ এ ১ বা মাইনাস এক দিয়ে শেষ করে দিচ্ছি বা এটা তো জাস্ট একটা কমার্শিয়াল সিনেমা বলে আর না দেখার অনুরোধ করছি— সেই সিনেমাটাই হয়ত কারো ভেঙে যাওয়া সংসারকে জোড়া লাগিয়ে দিচ্ছে বা কাউকে মানসিকরোগীদের পাশে থাকতে আশা দিয়ে যাচ্ছে। এই দুইজনকে আমি পরে আর কখনই এই দুইটা সিনেমা কতটা ভালো বা মন্দ বা রিমেক, সেই ব্যাপারে জ্ঞান দিতে যাই নাই। তাদের তীব্র অনুভূতির কাছে আমার সমস্ত সিনেমার জ্ঞান একদম তুচ্ছ।
এই দুইটা ঘটনা দেখার পর থেকে আমি সিনেমার রিভিউ লেখাটা একটু কমিয়ে দিয়েছি। বিশেষ করে যে সিনেমা আমার কাছ ভাল লাগে নাই, সেই সিনেমা নিয়ে। কী দরকার? কী ভালো লাগে নাই, সেটা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্যাঁচালের চেয়ে কোনটা দেখে মুগ্ধ হইসি, সেটাই না হয় মানুষকে জানাই। আর আমার যা ভাল্লাগে নাই, সেটা তো আরেকজনের ভালো লাগতে পারে, এই জিনিসটা মেনে নিতে এত সমস্যা ক্যান আমাদের?
শাহরুখ-সালমান বেঁচে থাকুক তাদের কাজের মাধ্যমে। সেটা উত্তম মানের কাজের মাধ্যমে কিংবা ‘ওম শান্তি ওম’, ‘কিউকি’র মতো ‘মধ্যম’ মানের কাজের মাধ্যমে। কারো কাছে হয়ত এই দুইটা সিনেমাই তাদের দুনিয়া।
পুনশ্চ, হিমেশ রেশমিয়ার কোন সিনেমার ক্ষেত্রে এই লেখা প্রযোজ্য হবে না। তারে দিয়া কিচ্ছু হয় না। তার সিনেমাকে আর তার সিনেমা যদি কেউ ভুলেও পছন্দ করে, দুটোকেই পঁচাতে হবে।
বিঃদ্রঃ লেখাটি ‘তারকা সংবাদ প্রেজেন্ট জাস্ট বলিউড রাইটিং কনটেস্ট ২০১৮’-এ তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে।