সালমান শাহর অপমৃত্যু নিয়ে মুখ খুললেন সামিরা

বাংলা সিনেমাপ্রেমী দর্শকের কাছে এক পরম আবেগের নাম সালমান শাহ। মাত্র চার বছরের ক্যারিয়ারে ২৭টি সিনেমা দিয়ে অমর হয়ে আছেন বাংলা সিনেমার এই রাজপুত্র। তিনি না থাকলেও তার অসাধারণ অভিনয়ে বুঁদ হয়ে আছে সিনেমাপ্রেমী প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

১৯৯২ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে খালার বান্ধবীর মেয়ে সামিরা হককে বিয়ে করেন তিনি। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক শফিকুল হক হীরার মেয়ে সামিরা তখন বিউটি পার্লার ব্যবসায় জড়িত। সালমান শাহের মৃত্যু নিয়ে ফের মুখ খুললেন সামিরা।

সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী বরাবরই বলে আসছেন, তার চিত্রনায়ক ছেলে আত্মহত্যা করেনি। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে খুন করা হয়েছে। অন্যদিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সাবেক প্রধান বনজ কুমার মজুমদার জানিয়েছিলেন, ‘সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছিলেন, তাকে খুন করা হয়নি।’ মৃত্যুর ২৬ বছর পরও যেন সালমানের মৃত্যুর রহস্য কাটছে না। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকা অবস্থায় সালমানের হঠাৎ মৃত্যুকে কেউ আত্মহত্যা, কেউ হত্যা বলেছে।

এদিকে ১৯ সেপ্টেম্বর সালমানের জন্মদিন উপলক্ষে শুক্রবার (২০ সেপ্টেম্বর) রাতে দেশের একটি টেলিভিশন চ্যানেলে সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয় সালমানের সাবেক স্ত্রী সামিরার। সেখানে সামিরা জোর দিয়ে জানিয়েছেন, সালমান শাহ আত্মহত্যা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, এর আগেও তিনবার তিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন।

সালমান কেন আত্মহত্যা করবেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ও (ইমন) মেন্টালি সুইসাইডাল বাই ন্যাচার। এর আগেও তিনবার সুইসাইডের চেষ্টা করেছে। মেট্রোপলিটন হাসপাতালের রেকর্ড চেক করলে সেটা জানা যাবে। সেখানে দুবারের রেকর্ড আছে। আরেক হাসপাতালে আছে তৃতীয় রেকর্ড। তিনটাই আমাদের বিয়ের আগের ঘটনা। তিনটা ঘটনাই আমি জানি। একবার মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করে করেছিল। আরেকবার আমাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য করেছে। আরেকবার ওর কিছু একটা হয়েছিল, সেটার জন্য।’

সালমান শাহ কেন আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে উঠলেন, সেই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে সামিরা বলেন, ‘ইমন কিন্তু ছবিতে ক্যারিয়ার করতে চায়নি। সে পড়াশোনা করতে চেয়েছিল। এরশাদ (হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ) ও নীলা চৌধুরীকে নিয়ে এক ঘটনায় নীলা চৌধুরী জেলে যান। তিনি ময়মনসিংহ কারাগারে থাকা অবস্থায় ইমন একদিনও তার মাকে দেখতে যায়নি। কেন? ইমন কিন্তু তার মাকে মা বা আম্মা বলে ডাকতো না, বলতো “মহিলা”। আমাদের সামনে অবশ্য ওভাবে বলতো না। নীলা চৌধুরী যখন শুটিং সেটে যেতেন, ইমন বলতো, “মহিলা আসছে”। সেটা শুনে ডলি জহুর আন্টি একদিন তাকে বকা দিয়ে বলেছিলেন। বলেছিলেন, “তুই এভাবে ডাকছিস কেন? তোর তো মা হয়।” ইমন তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছে।’

সামিরা আরও বললেন, ‘ইমনের মনে অনেক কষ্ট ছিল। ইমন অনেক কিছু দেখে বড় হয়েছিল, যেগুলো ওর দেখার কথা ছিল না। বাচ্চাদের ওপর সেসব ঘটনা বাজে প্রভাব ফেলে। আমরা এখন যেমন হিউম্যান সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করি, তখন তো এগুলো করতাম না। তখন আমাদের কোনো কাউন্সিলিংয়ের সুযোগ ছিল না। ছিল না রিহ্যাব। এখন রিহ্যাব আছে, কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা আছে। আমরা তেমন কিছু অনুভব করলে কারও সঙ্গে আলাপ করে তা ভাঙার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা। তখন তো ইমন এসব কাউকে বলতে পারেনি। “সালমান শাহ” হওয়ার পর তো আরও বলতে পারেনি। যাকেই বলবে, সেটা নিউজ হয়ে যাবে।’

১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মারা যান সালমান শাহ। মাত্র ২৫ বছরের জীবনে দেশের চলচ্চিত্রে রেখে গেছেন অসামান্য অবদান। বলা যায়, দেশের চলচ্চিত্রে ভিন্নধারার সূচনা হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। ছবিতে তাঁর উপস্থিতি মানেই ছিল নিশ্চিত সাফল্য, প্রেক্ষাগৃহে উপচে পড়া দর্শকের সরব উপস্থিতি। ছবির ব্যবসায়িক সাফল্য আর জনপ্রিয়তা—দুই–ই সমানতালে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি। অভিনয়ের স্বতন্ত্র ধারা আর ফ্যাশন সচেতনতা তাঁকে নিয়ে যায় ভিন্ন এক উচ্চতায়। এভাবে তিনি নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের ক্ষণজন্মা নায়ক সালমান শাহ।

১৯৮৬ সালে ছায়ানট থেকে পল্লীগীতিতে পাস করেছিলেন সালমান। চলচ্চিত্রে আসার আগেই ১৯৯২ সালের ১২ আগস্ট বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী ছিলেন সামিরা হক। সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় অভিনয় করেই আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পান সালমান শাহ। কিন্তু তার আগেই তিনি নাটকে অভিনয় করেন। মঈনুল আহসান সাবেরের লেখা ধারাবাহিক ‘পাথর সময়’-এ একটি চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে তার অভিনয়জীবন শুরু হয়। ওই নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রে তৌকীর আহমেদ অভিনয় করলেও সালমান শাহর চরিত্রটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরে আরও বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেও দারুণ প্রশংসিত হয়েছিলেন।

মৌসুমীর সঙ্গে ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ সিনেমায় সালমানের অভিষেক হয়। পরে মৌসুমীর সঙ্গে আরও দুটি সিনেমা ‘স্নেহ’ ও ‘অন্তরে অন্তরে’ অভিনয় করলেও আর কোনো সিনেমায় তাদের দেখা যায়নি। অন্যদিকে শাবনূরের সঙ্গেই বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন সালমান শাহ; যে জুটিকে এখনো সিনেমার অন্যতম সেরা জুটি হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। সালমানের সঙ্গে জুটি হয়ে আরও অভিনয় করেছিলেন শাবনাজ, শাহনাজ, লিমা, শিল্পী, শ্যামা, সোনিয়া, বৃষ্টি, সাবরিনা ও কাঞ্চি। জীবদ্দশায় নিজের অভিনীত যেসব সিনেমার সফলতা উপভোগ করে যেতে পেরেছিলেন সেই সিনেমাগুলো হলো—‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’, ‘প্রেম যুদ্ধ’, ‘কন্যাদান’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘মহামিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’, ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’ ও ‘স্বপ্নের পৃথিবী’।

সালমান শাহ জীবদ্দশায় সর্বশেষ ‘স্বপ্নের পৃথিবী’ সিনেমার সাফল্য উপভোগ করে যেতে পেরেছিলেন। সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই। সালমান শাহ যেদিন মারা যান, সেদিন রায়হান মুজিব পরিচালিত ‘আখেরী মোকাবেলা’ সিনেমাটি মুক্তি পেয়েছিল। আর এর পরের সপ্তাহ অর্থাৎ ১৩ সেপ্টেম্বর (১৯৯৬) মুক্তি পেয়েছিল ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ সিনেমাটি। তার মৃত্যুর পর যে সিনেমাগুলো একের পর এক দর্শকের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয় এবং ব্যবসা সফল হয়, সেই সিনেমাগুলো হচ্ছে—‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’ ও ‘বুকের ভেতর আগুন’। সালমান শাহর মৃত্যুর ঠিক এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তার অভিনীত সর্বশেষ মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা ছিল ‘বুকের ভেতর আগুন’।

Leave a Reply

Your email address will not be published.