একটি টক শো অনুষ্ঠানকে ঘিরে সমালোচনার মুখে হুমায়ুন আহমেদের পুত্র নুহাশ হুমায়ূন৷ বাবা হুমায়ূন আহমেদের জন্য তিনি এই পর্যন্ত আসতে পেরেছেন কিনা- এমন প্রশ্নে বিরক্ত হন নুহাশ। এ নিয়ে চলছে নানান আলোচনা সমালোচনা৷
অবশেষে সব আলোচনার ইতি টানতে নুহাশ আজ ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন
নিম্নে ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
‘‘সবাইকে ধন্যবাদ, আপনাদের সহানুভূতি, সুচিন্তিত মতামত এবং ভালোবাসা নিয়ে আমার পাশে থাকার জন্য। আমার সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতা জানানোর পর, অনেকেই আমাকে তাদের নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। দেখলাম, আমি-ই প্রথম এমন মানুষ না যে মিডিয়ার সামনে অপ্রস্তুত হয়েছি আর অপমানিত বোধ করেছি। এরমধ্যে ভালো লাগছে যে আমি আমার অনুভূতির কথা সরাসরি লিখেছি, অনেকে হয়তো তাদেরটা বলতে পারেননি।
আবার খেয়াল করলাম, অনেক পেইজ, সঞ্চালকের ছবি দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মন্তব্য করছেন। আমি কোনোভাবেই এ ধরনের সাইবার বুলিং সমর্থন করি না। আমি মনে করি, কিছু প্রশ্ন আপত্তিকর ছিল, কিন্তু এখন মিডিয়ায় এটাই একটা প্রবণতা হয়ে গিয়েছে। এর সমাধান করতে চাইলে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে যেন তারা শ্রদ্ধাশীল থাকেন। কিন্তু কোনোভাবেই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যবহারের উত্তর সে রকম ব্যবহার হওয়া উচিত না। শেষ ‘ষ’-এর পর্বে একটা লাইন ছিল ‘দোষের চেয়ে বিচার বেশি’ সেই অবস্থা যেন না হয়।
আমি চাই, ইন্টারভিউয়ের আগে কী নিয়ে আলোচনা হবে, সেটার স্বচ্ছতা থাকুক। প্রথম আলো ক্যাফে লাইভের ইন্টারভিউর আগে আমাকে বলা হয়েছে এটা মূলত ‘ষ’ নিয়ে আলোচনা। হয়তো কিছু কথা হবে বাবাকে নিয়ে। আমি সেটার জন্যই প্রস্তুত ছিলাম।
অতীতে, আমার পরিবার নিয়ে আন্তরিকভাবেই ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছি। সেখানে আমার জীবনে আমার মায়ের ভূমিকার কথা বলেছি, আমার বাবাকে নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু এই ধরনের ইন্টারভিউয়ের জন্য আমার মানসিক প্রস্তুতি লাগে। আমি হঠাৎ করে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হলে অপ্রস্তুত হয়ে যাই।
এটা মনে করিয়ে দিতে পারি, আমি ১৯ বছর বয়সে আমার বাবাকে হারিয়েছি। আমি আমার বাবাকে ঠিকভাবে বিদায় জানাতে পারিনি, কারণ চারদিকে ছিল ক্যামেরা আর সাংবাদিক। একটা মুহূর্ত একা তার পাশে বসতে পারিনি তাকে শুইয়ে দেওয়ার আগে! তাই হঠাৎ যদি লাইভ অনুষ্ঠানে আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়, বাবা আমার জীবনে না থাকলে সেটা কেমন হতো। আমি অপ্রস্তুত হয়ে যাই। আমার জন্য এই বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর। এছাড়াও আমার মনে হয়, আমার জীবনে বাবার ভূমিকা নিয়ে কথা বলার জন্য- বাবা জীবনে না থাকলে কী হতো/ কেমন হতো- এই প্রশ্নগুলো খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নয়।
আমার খুব ভালো লেগেছে, কয়েক দিন আগে রাহাত রহমানের সঙ্গে একটা পডকাস্ট করেছি। সেখানে তিনি জানতে ছেয়েছেন, কীভাবে দেশের বাইরে বিভিন্ন অনুদানের জন্য আবেদন করা যায়। যেহেতু আমি সানডেনস চলচ্চিত্র উৎসবে, ফিল্ম ইন্ডিপেন্ডেন্ট এবং স্লোয়ান সামিটে অংশগ্রহণ করেছি। আরেকটা সাক্ষাৎকারে কথা বলেছি আমার বাবার লেখা উপন্যাসের মধ্যে কোনটা আমার সবচেয়ে প্রিয়- তা নিয়ে। এবং এটাকে ভিজুয়াল মিডিয়ায় রূপ দেওয়ার জন্য কে হতে পারেন সবচেয়ে যোগ্য সহযোগী। এসব সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তরুণ সঞ্চালকরা। আর সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময়ই বোঝা গিয়েছে তারা আমার কাজ নিয়ে খোঁজ-খবর নিয়েছেন। বড় বড় প্রতিষ্ঠান থেকেও আমি সেটাই আশা করি।
আমি যেসব কাজ করেছি, যতটুকু করেছি এবং যেখান থেকে আমি এসেছি- সবকিছু নিয়ে আমি খুব বিনয়ের সাথেই গর্বিত। আমার নিজের অর্জন বা সাফল্য নিয়ে কথা বললে দেখি অনেকেই খুব বিরক্ত হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অজানা একজন মানুষের সাফল্যে কেন তাদের এত বিরক্ত করে সেটাও বুঝি না! আমার মনে হয়, আমাদের শেখানো হয়, আমাদের অর্জনের কথা শুধু সিভিতে লেখা যাবে, মুখে বলা যাবে না। মুখে বলার মানে হলো, ‘সে খুব অহংকারী’, ‘বড় বড় কথা বলে’ অথবা ‘নিজেকে কী মনে করে’। এই ধারণাগুলো পাল্টানো দরকার। নিজেদের অর্জনের কথা মাথা উঁচু করেই বলা উচিত।
আমি আমার পরিবার নিয়ে প্রচণ্ডভাবে গর্বিত। আমি আমার বাবাকে ভালোবাসি আর কখনোই আমার জীবনে তার প্রভাবকে অস্বীকার করি না। ‘আলোর মশাল’ লেখাটায় আমি লিখেছিলাম, কীভাবে আমার বাবা আমার জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে দিয়েছেন আর কেমন করে ছোটবেলার আমি তার মতো হবার চেষ্টা করতাম। কীভাবে আর কেনই বা আমি আমার বাবা বা মার প্রভাবকে অস্বীকার করবো!
যখন তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি, আমার একটা লেখা পড়ে, আমার মার মনে হয়েছিল এই স্কুল আমার সৃজনশীলতাকে ঠিক মতো মূল্যায়ন করছে না। তিনি আমার স্কুল বদলে দিয়েছিলেন। মা আমার ১৩ বছর বয়সে একটা ডিজিটাল ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। সেটা দিয়ে আমি আমার প্রথম শর্ট ফিল্ম বানানো শুরু করি।
আমি যা কিছু তৈরি করি, সবকিছুতে আমি আমার মার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। আমার তো বাবাকে কৃতজ্ঞতা জানানো লাগে না, আমার নামের সাথেই তো আছেন সবসময়। কিন্তু মায়ের নাম আছে আমার সমস্ত নির্মাণে, সবকিছুতেই। মাকে ছাড়া আমি কখনোই আজকের জায়গায় আসতে পারতাম না।
আমার দেখা শ্রেষ্ঠ সিনেমাগুলো আমি দেখেছি আমার বাবার সাথে। বাবা আমার চলচ্চিত্রের প্রতি ভালোবাসা তৈরি করে দিয়েছেন। আমার মা, সেই ভালোবাসার ছবি তৈরির পাশে আছেন। আমি বলতে দ্বিধা করবো না, আমার বাবার অর্জনের পেছনেও আমার মায়ের ভূমিকা অপরিসীম। আমার মনে হয়, হুমায়ূন আহমেদ বা নুহাশ হুমায়ূন কেউই সামনে এগিয়ে যেতে পারতো না, গুলতেকিন খানকে ছাড়া।
তাই আমার অনুরোধ থাকবে, কেউ আমার জীবনে বাবার ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন করার সাথে সাথে মায়ের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন করুন। আর যদি ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চান, অনুগ্রহ করে আগে থেকেই জানিয়ে রাখবেন। আমি প্রস্তুত থাকবো। ধন্যবাদ।’’